শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব ও নাগরিকদের জন্য সুফল। জানুন কীভাবে একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার, নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক সুযোগ নিশ্চিত করে। শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয়তা ও এর উপকারিতা নিয়ে বিশ্লেষণ—ভোটাধিকার, সুশাসন ও গণতন্ত্রের সুরক্ষায় এর ভূমিকা।
একটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণ হচ্ছে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। আর এই নির্বাচন ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালনার দায়িত্বে থাকে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। যদি কমিশন রাজনৈতিক চাপমুক্ত, আইনপ্রয়োগে সক্রিয় ও জবাবদিহিমূলক হয়, তবে তা শুধু একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করেই না, বরং দেশবাসীর জন্য আরও নানা সুবিধা ও অধিকারের বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে।
নির্বাচন কমিশন কেন শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন
গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি হলো জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এবং জনগণের শাসন। এই শাসনব্যবস্থা কার্যকর করতে হলে প্রয়োজন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। আর নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব যাদের ওপর, সেই নির্বাচন কমিশন যদি শক্তিশালী না হয়, তবে গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়, জনগণের আস্থা নষ্ট হয় এবং সুশাসনের পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। তাই সময়ের দাবি—একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন।
১. ভোটারদের ভোটাধিকার সুরক্ষিত হয়
শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে। এতে কেউ সহজে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না। ভোটার তালিকা হালনাগাদ থাকে, ভূয়া ভোটার কমে যায় এবং নাগরিকরা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে। এতে জনগণের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আস্থা বাড়ে।
২. নিরাপদ ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন
একটি কার্যকর কমিশন নির্বাচনের সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সহিংসতা রোধ করতে পারে। এতে ভোটার, প্রার্থী ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকলেই নিরাপদ থাকে। ভোটকেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকে, যাতে সবাই নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে।
৩. সমান সুযোগ ও প্রতিযোগিতার নিশ্চয়তা
শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করে। কোনো প্রভাবশালী দল বা প্রার্থী যাতে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র বা সম্পদ ব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত করা হয়। সব দল মিডিয়া কাভারেজ, সভা-সমাবেশ ও প্রচারণার সমান অধিকার পায়।
৪. নিরপেক্ষ ফলাফল ও জনআস্থার ভিত্তি
যখন নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করে, তখন ভোটের ফলাফল জনগণ বিশ্বাস করে। এতে সমাজে বিভক্তি কমে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে। বিরোধী দল ফলাফল মেনে নেয় এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
৫. মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা পায়
শক্তিশালী কমিশন নির্বাচন-পূর্ব সময়ে ভোটারদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ, সমাবেশ করার অধিকার নিশ্চিত করে। মিডিয়া, সিভিল সোসাইটি ও পর্যবেক্ষকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়। এতে নির্বাচন হয় স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য।
৬. দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস পায়
যখন কমিশন দুর্নীতিমুক্ত ও পেশাদার হয়, তখন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমে। আর্থিক লেনদেন, ভোট কেনা বা জালিয়াতির আশঙ্কা অনেকটাই হ্রাস পায়। এতে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীরা নির্বাচন করার সাহস পান এবং জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি নির্বাচিত হন।
৭. নারী ও সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ বাড়ে
শক্তিশালী কমিশন বিশেষভাবে নারীদের, সংখ্যালঘুদের ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে উৎসাহ দেয়। নিরাপদ পরিবেশ ও সচেতনতা বাড়িয়ে তাদের ভোটদান ও প্রার্থী হওয়া নিশ্চিত করে। ফলে গণতন্ত্র আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়।
৮. ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গঠনে সহায়ক
সুস্থ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সমাজের শিক্ষিত, দক্ষ ও তরুণ নেতৃত্ব উঠে আসতে পারে। শক্তিশালী কমিশনের অধীনে পরিচালিত নির্বাচন ভবিষ্যতের জন্য যোগ্য নেতৃত্ব বাছাইয়ে সহায়ক হয়।
একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। দুর্বল কমিশন রাজনৈতিক চাপে নির্বাচন পরিচালনা করে, যার ফলে ভোট কারচুপি, জাল ভোট, প্রভাব বিস্তার ইত্যাদি ঘটতে থাকে। অন্যদিকে, শক্তিশালী কমিশন নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা বজায় রাখে—প্রার্থীদের মনোনয়ন, ভোট গ্রহণ, গণনা ও ফলাফল ঘোষণায় সঠিক নিয়ম মেনে চলে।
শক্তিশালী কমিশন প্রত্যেক নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে। এটি ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে, ফটো আইডি ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভোটিং পদ্ধতিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। কেউ যেন ভোট দিতে না পারে অথবা একাধিকবার না দিতে পারে—তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
নির্বাচন কমিশন যদি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ হয়, তাহলে সব রাজনৈতিক দল সে কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে পারে। এতে রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল হয়, নির্বাচন বর্জন বা সহিংসতা কমে যায়। সবাই ফলাফল মেনে নেয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়।
দুর্বল কমিশন প্রভাবশালী দল বা প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পায়। এতে নির্বাচন দুর্নীতিগ্রস্ত হয় এবং সাধারণ প্রার্থীরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। শক্তিশালী কমিশন নিরপেক্ষভাবে আইন প্রয়োগ করে, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনকারীদের জরিমানা, বাতিল বা কারাদণ্ড পর্যন্ত দিতে পারে।
কমিশন যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে তা নারী, সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী, আদিবাসীসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়। এমনকি এসব শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে নীতিগত ব্যবস্থা নিতে পারে। ফলে নির্বাচন হয় আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
একটি দেশে যদি বারবার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক মহলে দেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি উন্নত হয়। বিদেশি বিনিয়োগ ও কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়। এতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন গতি পায়। এই অর্জনের পেছনে থাকে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অবদান।
শক্তিশালী কমিশনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নিজের ভোটে নির্বাচিত করতে পারে। ফলাফল সবাই গ্রহণ করে এবং সহিংসতা ছাড়াই এক দল থেকে আরেক দলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।
শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন যোগ্য ও দক্ষ প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এতে সৎ, জনদরদি এবং দূরদর্শী নেতারা দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর ফলেই রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায়—যেখানে দুর্নীতি কমে, জনসেবা বাড়ে, এবং জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার পায়।
মুজিব হত্যা নয়। সেনা অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হয়েছেন
একটি রাষ্ট্রে নির্বাচন কমিশনের শক্তি মানেই জনগণের অধিকার রক্ষার শক্তি। দুর্বল কমিশন মানে প্রশ্নবিদ্ধ গণতন্ত্র, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ন্যায়বিচারের অভাব। পক্ষান্তরে, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন মানে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের সঠিক ভিত্তি। তাই জনগণের স্বার্থেই নির্বাচন কমিশনকে হতে হবে স্বাধীন, দক্ষ ও শক্তিশালী।