স্বাস্থ্যহানী কি? কেন ঘটে, কীভাবে বুঝবেন এবং প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করবেন-এই বিষয়ে বিস্তারিত চিকিৎসামূলক তথ্যসহ একটি সচেতনতা মূলক প্রতিবেদন।
স্বাস্থ্যহানী বলতে শরীর বা মনের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতায় নেতিবাচক পরিবর্তনকে বোঝায়। এটি সাময়িক হতে পারে, আবার দীর্ঘমেয়াদেও হতে পারে। স্বাস্থ্যহানী যে শুধু রোগব্যাধির মাধ্যমেই হয় এমন নয়, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন পদ্ধতি, মানসিক চাপ, দূষণ, বিশ্রামের অভাব, এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ—এসবও স্বাস্থ্যহানীর প্রধান কারণ হতে পারে।
স্বাস্থ্যহানী দুই প্রকার:
-
শারীরিক স্বাস্থ্যহানী: যেমন – জ্বর, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, হজমে সমস্যা, রক্তচাপের অস্বাভাবিকতা ইত্যাদি।
-
মানসিক স্বাস্থ্যহানী: যেমন – দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি।
স্বাস্থ্যহানী ঘটলে বোঝার উপায়
স্বাস্থ্যহানী অনেক সময় ধীরে ধীরে দেখা দেয়। কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখে সহজেই বোঝা যায় যে আপনার স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে:
শারীরিক লক্ষণ:
-
সবসময় ক্লান্ত লাগা
-
মাথাব্যথা বা মাথা ঘোরা
-
ক্ষুধামান্দ্য বা অতিরিক্ত ক্ষুধা
-
ওজন কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
-
ঘন ঘন জ্বর বা ঠান্ডা লাগা
-
হজমে সমস্যা, যেমন পেট ফাঁপা, গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য
-
ত্বকের রঙ ফ্যাকাশে হওয়া বা অ্যালার্জি
-
ঘুমের সমস্যা
মানসিক লক্ষণ:
-
মনমরা ভাব
-
একাকীত্বের অনুভব
-
উদ্বিগ্নতা বা আতঙ্ক
-
হঠাৎ মেজাজ পরিবর্তন
-
কাজের প্রতি অনীহা
-
আত্মবিশ্বাসের অভাব
স্বাস্থ্যহানী হলে করণীয়
স্বাস্থ্যহানী ঠেকাতে হলে আগে থেকেই সতর্কতা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নিচে কিছু করণীয় দেওয়া হলো:
সুষম খাদ্য গ্রহণ:
-
প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার খান।
-
অতিরিক্ত চিনি, লবণ, তেল এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন।
নিয়মিত ব্যায়াম:
-
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করুন।
-
শরীরকে সচল রাখলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
পর্যাপ্ত ঘুম:
-
দিনে ৭–৮ ঘণ্টা নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম খুব জরুরি। তবে সুস্থ ব্যক্তির জন্য ৬ ঘণ্টা ঘুম যথেষ্ট
-
ঘুমের অভাব মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য উভয়ের ক্ষতি করে।
মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা:
-
মেডিটেশন, যোগ ব্যায়াম ও বই পড়া আপনাকে মানসিকভাবে শান্ত রাখতে সাহায্য করে।
-
প্রয়োজনে কাউন্সেলিং গ্রহণ করুন।
প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা:
-
বছরে অন্তত একবার ফুল বডি চেকআপ করুন।
-
ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, কলেস্টেরল ইত্যাদি পরীক্ষা করুন।
মাদক ও ধূমপান থেকে বিরত থাকুন:
-
তামাক ও অ্যালকোহল শরীরের নানা অঙ্গের ক্ষতি করে।
-
এগুলো থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকাই ভালো।
চিকিৎসকের পরামর্শ:
-
যদি কোনো অসুস্থতা এক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
-
স্ব-চিকিৎসা নয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা গ্রহণ করুন।
স্বাস্থ্যহা’নী একটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা বিপদ যা সচেতন না হলে বড় ধরনের জটিলতায় পরিণত হতে পারে। তাই শরীরের ছোট ছোট সংকেতগুলোকেও গুরুত্ব দিন। স্বাস্থ্যই সম্পদ – এই কথাটির গভীরতা প্রতিদিন অনুভব করুন। সচেতনতা, নিয়মিত জীবনযাপন ও চিকিৎসার প্রতি যত্নশীল হলে স্বাস্থ্যহা’নী প্রতিরোধ সম্ভব।
আপনার শরীর আপনার ভবিষ্যতের গন্তব্য নির্ধারণ করে। তাই স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিন, চিকিৎসাকে অগ্রাধিকার দিন।
স্বাস্থ্যহানী হওয়ার কারণ কি?
স্বাস্থ্যহা’নী নানা কারণে ঘটে থাকে। কিছু কারণ আমাদের নিয়ন্ত্রণে, আবার কিছু কারণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। নিচে স্বাস্থ্যহা’নীর প্রধান কারণগুলো তালিকাভুক্ত করা হলো:
স্বাস্থ্যহানীর প্রধান কারণসমূহ
১. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
-
ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাওয়া
-
অতিরিক্ত চিনি, লবণ ও চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ
-
অপ্রতুল পানি পান
-
অনিয়মিত খাবার খাওয়া
২. অলস জীবনযাপন
-
দৈহিক পরিশ্রমের অভাব
-
দীর্ঘ সময় বসে থাকা (desk job, TV দেখা ইত্যাদি)
-
ব্যায়ামের অভ্যাস না থাকা
৩. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ
-
হতাশা বা বিষণ্ণতা
-
পারিবারিক, ব্যক্তিগত বা পেশাগত চাপ
৪. পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব
-
রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া
-
ঘুমের সময় ও নিয়মের অবহেলা
-
ঘন ঘন ঘুম ভেঙে যাওয়া
৫. নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার
-
ধূমপান ও তামাক সেবন
-
মদ্যপান ও অন্যান্য মাদক গ্রহণ
-
ওষুধের অপব্যবহার
৬. দূষণ ও পরিবেশগত সমস্যা
-
বায়ু দূষণ
-
শব্দ দূষণ
-
পানি বা খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্য
৭. সংক্রমণ ও জীবাণুর আক্রমণ
-
ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস সংক্রমণ
-
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব
-
টিকা গ্রহণ না করা
ডায়াবেটিস কি, লক্ষণ ও প্রতিকার – ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করণীয় জেনে নিন
৮. জিনগত বা বংশগত কারণ
-
পরিবারে কোনো নির্দিষ্ট রোগের ইতিহাস থাকলে
-
ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা ক্যানসার জাতীয় রোগ বংশগতভাবে আসতে পারে
৯. অতিরিক্ত বা ভুল ওষুধ সেবন
-
নিজের ইচ্ছেমতো ওষুধ খাওয়া
-
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ গ্রহণ
-
বেশি দিনের ওষুধ গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
১০. দুর্ঘটনা ও শারীরিক আঘাত
-
রোড এক্সিডেন্ট, খেলাধুলায় আঘাত
-
হাড়ভাঙা, পেশীতে টান ইত্যাদি
১১. স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসায় অবহেলা
-
অসুস্থতা দীর্ঘদিন অবহেলা করা
-
রোগের লক্ষণ বুঝেও চিকিৎসকের কাছে না যাওয়া
-
নিয়মিত চেকআপ না করা
স্বাস্থ্যহানী সাধারণত আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাসের ফলাফল। সচেতনতা, সঠিক জীবনযাপন এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যা সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
অসুস্থতার চেয়ে প্রতিরোধই সহজ ও নিরাপদ।